![]() |
টাকা থাকলে সবাই আপন, বিপদে পড়লে সবাই অচেনা – সম্পর্কের নির্মম বাস্তবতা |
✍️ ভূমিকা:
“যখন তোমার টাকা পয়সা থাকবে, তখন সবাই তোমাকে মূল্য দিবে। কিন্তু যখন তুমি বিপদে পড়বে, কেউ তোমার পাশে থাকবে না বরং তখন নানান অজুহাতে তোমার থেকে দূরে সরে যেতে চাইবে। দোষ না করলেও দোষ দিবে, আসলে তখন তাদের উদ্দেশ্য একটাই—তোমার থেকে দূরে সরে যাওয়া।”
এই কথাগুলো হয়তো আপনি অনেকবার শুনেছেন। কিন্তু যদি মন দিয়ে ভাবেন, তাহলে বুঝবেন—এটা শুধুই একটা কোট বা স্ট্যাটাস নয়, এটা আমাদের জীবনের গভীর ও তিক্ত এক বাস্তবতা। টাকা ও সময় যখন হাতে থাকে, তখন ‘আপনজন’ গিজগিজ করে। কিন্তু যখন কিছুই থাকে না, তখন তাদের কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায় না।
এই ব্লগে আমরা বিশ্লেষণ করব—কেন এমনটা হয়, মানুষের মনস্তত্ত্ব কেমন, সমাজ কীভাবে আমাদের সম্পর্কগুলোকে প্রভাবিত করে, এবং আমরা কীভাবে নিজেদের সামলে নিতে পারি।
🧠 মানুষের মনস্তত্ত্ব এবং সম্পর্কের ধরণ:
মানুষ মূলত স্বার্থান্বেষী প্রাণী। একে বলা হয় Reciprocal Altruism — অর্থাৎ মানুষ এমন উপকার করতে চায় যার বিনিময়ে কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
🎯 উদাহরণ:
যখন আপনার হাতে টাকা থাকে, তখন আপনার কাছ থেকে কেউ না কেউ উপকার পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তখন তারা আপনাকে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু যখন আপনি অর্থহীন হন, তখন তারা ভাবে, “এখন তার কোনো মূল্য নেই। কাজের সময় সাহায্যও করতে পারবে না।”
এই মনোভাবটি এক ধরনের Survival Psychology – মানুষ অবচেতনভাবে নিজের সুবিধা খোঁজে।
💸 টাকার উপস্থিতি বনাম অনুপস্থিতি: সম্পর্কের রূপান্তর
আপনার কাছে টাকা থাকলে:
-
আপনাকে সবাই ফোন করবে
-
দাওয়াতে ডাকবে
-
আপনার মতামতকে মূল্য দেবে
-
আপনার কথায় গুরুত্ব থাকবে
কিন্তু টাকা না থাকলে:
-
“ব্যস্ত আছি” বলা শুরু করবে
-
ছোট ছোট বিষয়ে আপনাকে দোষ দেবে
-
আপনার অবস্থাকে গুরুত্ব দেবে না
-
আপনার মানসিক অবস্থা বুঝতে চাইবে না
👉 এটি একটি মানবিক স্বার্থনির্ভরতা (conditional bonding) – যে সম্পর্কগুলো শর্তসাপেক্ষ।
📖 বাস্তব জীবনের কিছু কাহিনি
গল্প ১: সুমনের গল্প
সুমন চাকরিরত অবস্থায় খুব সাহায্যপ্রবণ ছিল। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়–সবাই তার পাশে থাকত। কিন্তু হঠাৎ চাকরি হারালে সে আর আগের মত ফোন পেত না, কেউ দেখা করতে আসত না। এমনকি যাদের সে সাহায্য করেছিল, তারাও ফিরেও তাকায়নি।
গল্প ২: লিজার বাস্তবতা
লিজা যখন তার ছোট ব্যবসায় লাভ করছিল, তখন আত্মীয়রা বলত, "তুই আমাদের গর্ব।" কিন্তু করোনায় ব্যবসা ডুবে যাওয়ার পর কেউ তার খোঁজও নেয়নি। শুধু "তুই তো এমনিতেই বাজে ডিসিশন নিস!" বলে তাকে অপমান করেছিল।
🔍 কেন সম্পর্কগুলো এমন হয়ে যায়?
১. সমাজের চাহিদা-ভিত্তিক সংস্কৃতি
আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে মানুষ "তোমার কী আছে?" তা দিয়েই তোমার মূল্য নির্ধারণ করে।
২. ঈর্ষা ও হিংসা
আপনার উন্নতি সহ্য হয় না অনেকের। আবার বিপদে পড়ে গেলে, তারা মনে মনে খুশি হয়, "ওর অবস্থা এখন আমার চেয়ে খারাপ!"
৩. দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা
বেশিরভাগ মানুষ নিজেকে ছাড়া কাউকে বুঝতে চায় না। ফলে আপনার কষ্ট তাদের কাছে কোনো গুরুত্ব পায় না।
🌱 নিজেকে কীভাবে সামলাবেন?
✅ ১. আত্মনির্ভর হোন:
নিজের অর্থনৈতিক ও মানসিক শক্তি গড়ে তুলুন। কারো উপরে নির্ভর করবেন না।
✅ ২. আসল বন্ধুদের চিনুন:
আপনার খারাপ সময়ে যে পাশে থাকে, তিনিই আপনার আপন।
✅ ৩. সীমা নির্ধারণ করুন:
আপনার শক্তি, সময় ও অর্থ—এই তিনটি বিষয় বেছে বেছে ব্যবহার করুন।
✅ ৪. নিয়মিত নিজেকে উন্নত করুন:
নতুন স্কিল শেখা, আত্মবিশ্বাস বাড়ানো—এই সব আপনাকে সামাজিকভাবে শক্তিশালী করে তুলবে।
✅ ৫. "না" বলতে শিখুন:
সবাইকে খুশি করতে গেলে আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। তাই ‘না’ বলার সাহস রাখুন।
❤️ গল্প: "রফিকের চা দোকানটা আজ বন্ধ"
রফিক ছিল শহরের এক কোণে ছোট্ট একটি চা দোকানের মালিক। খুব একটা বড় দোকান না, তবে সকাল-বিকেল মানুষের ভিড় লেগে থাকত। যারা আসত, তাদের কেউ চাকুরিজীবী, কেউ ছাত্র, কেউ রিকশাচালক, কেউবা পথচারী। রফিক সবাইকে একরকম আপন করে নিয়েছিল।
চায়ের কাপের সঙ্গে সে দিত অল্প হাসি, মজার গল্প আর একটুখানি সহানুভূতি। সবাই বলত, “রফিক ভাই, আপনার মতো মানুষ এখনকার দিনে খুব কম পাওয়া যায়!”
একদিন হঠাৎ করে খবর এলো—রফিক গুরুতর অসুস্থ। হেপাটাইটিস বি ধরা পড়েছে। দোকান বন্ধ। চিকিৎসা দরকার, বিশ্রাম দরকার। প্রথম কিছুদিন মানুষ খোঁজ নিয়েছিল। কেউ ৫০০, কেউ ১০০০ টাকা সাহায্যও করেছিল।
কিন্তু কয়েক সপ্তাহ যেতে না যেতেই সবাই চুপ। রফিকের ফোন কেউ ধরত না। দোকানের সামনে গিয়ে ফিরে আসত। যে চায়ের আড্ডা ছিল একসময় প্রাণবন্ত, সেখানে এখন নীরবতা।
তিন মাস পর রফিক সুস্থ হয়ে দোকান খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু সেই চেনা মুখগুলো আর ফিরে এল না। কেউ বলল, "ব্যস্ত ছিলাম ভাই", কেউবা "এখন নতুন দোকানে যাই, ওখানে বসে অভ্যাস হয়ে গেছে।"
রফিক একদিন বলেছিল,
"ভাই, আমি শুধু বুঝেছি, মানুষ যতক্ষণ আপনাকে কিছু দিতে পারবে, ততক্ষণই আপনি তার 'আপন'। আমার চা, হাসি, গল্প—সবই তাদের দরকার ছিল, যতক্ষণ আমি দিতে পেরেছি। এখন আমি শুধু রফিক—not ‘রফিক ভাই’।”
✅ উপসংহার:
সমাজের মানুষ আপনার পাশে তখনই থাকবে, যখন আপনি তাদের কিছু দিতে পারবেন। এই সত্যটা তিক্ত হলেও মেনে নেওয়া উচিত। টাকা থাকলে সবাই কাছে আসে, আর বিপদে সবাই দূরে সরে যায়—এটাই বাস্তবতা।
কিন্তু আপনি যদি এই বাস্তবতাকে ঠিকভাবে বুঝে নেন, তাহলে আপনি কারো অবজ্ঞায় ভাঙবেন না বরং আরও দৃঢ় হবেন। নিজের শক্তি, সততা এবং আত্মসম্মানের উপর ভর করে আপনি নতুনভাবে জীবনে এগিয়ে যেতে পারবেন।
❓ প্রশ্ন-উত্তর সেকশন:
প্রশ্ন ১: কেন আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুরাও বিপদের সময় পাশে থাকে না?
উত্তর: অনেকে বন্ধুত্ব করে সুবিধা পাওয়ার আশায়। বিপদে পড়ে গেলে তারা মনে করে আপনি এখন “বোঝা”। তাই দূরে সরে যায়।
প্রশ্ন ২: কীভাবে আমি আসল বন্ধুদের চিনব?
উত্তর: খারাপ সময়ে যারা বিনা স্বার্থে পাশে থাকে, তারাই আসল বন্ধু। তারা আপনার অবস্থার ওপর ভিত্তি করে সম্পর্ক নির্ধারণ করে না।
প্রশ্ন ৩: কীভাবে মানসিকভাবে নিজেকে শক্ত রাখা যায়?
উত্তর: আত্মউন্নয়নমূলক বই পড়ুন, মেডিটেশন করুন, জার্নাল লিখুন। নিজেকে নিজের সবচেয়ে ভালো বন্ধু করে তুলুন।
প্রশ্ন ৪: সম্পর্ক থেকে কীভাবে নিজেকে বাঁচানো যায়?
উত্তর: আপনি সীমা নির্ধারণ করুন, প্রত্যাশা কমান এবং নিয়মিত নিজের মূল্য বুঝে চলুন।
✍️ পাঠকের উদ্দেশ্যে কিছু কথা:
আপনি যদি এই লেখাটি পড়ে নিজেকে খুঁজে পান, তাহলে জেনে রাখুন—আপনি একা নন। আমাদের অনেকেই এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। কিন্তু আমরা হেরে যাইনি। কারণ আমরা বুঝেছি, জীবনের আসল শক্তি অন্যদের ওপর নয়, নিজের ভেতরের সাহসে।
🙏 ধন্যবাদ!
এই লেখাটি আপনার ভালো লেগে থাকলে "Jiboner Gholpo" ব্লগে অন্যান্য লেখাগুলোও পড়তে পারেন।
-
#মানবিক_মনস্তত্ত্ব
-
#সম্পর্কের_বাস্তবতা
-
#জীবনের_গল্প
-
#আত্মউন্নয়ন
-
#বন্ধুত্ব
-
#প্রতিকূলতার_মধ্যেও_শক্তি
-
#টাকা_ভিত্তিক_সম্পর্ক
-
#অস্বার্থ_বন্ধুত্ব
0 মন্তব্যসমূহ